Voyager - 1 (ভয়েজার ওয়ান)

 ভয়েজার ওয়ান -


পৃথিবীতে মানব তৈরি ভয়েজার ওয়ান স্পেসক্রাফটি বর্তমানে আমাদের থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। 1977 সালের 5 সেপ্টেম্বর ভয়েজার ওয়ান স্পেসক্রাফটি লঞ্চ করা হয়। তবে ভয়েজার টু এর 15 দিন পর ভয়েজার ওয়ান লঞ্চ করা হয়েছে। মানব তৈরি এইটা প্রথম স্পেসক্রাফট যেইটা পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অতিক্রম করেছে। এই 721.9 কিলোগ্রাম ওজনের মহাযানটি বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ কে অতিক্রম করেছে। আমাদের সৌরজগৎ এর গ্রহগুলোকে পর্যবেক্ষণ এবং ছবি তোলে পাঠানো প্রথম স্পেসক্রাফট। ভয়েজার ওয়ান প্রথম স্পেসক্রাফট যেইটা সৌরমন্ডলের বাইরে চলে গেছে এবং মহাবিশ্বের অন্ধকারে গিয়ে সেখান থেকে আমাদের ইনফর্মেশন পাঠাচ্ছে। ভয়েজার ওয়ান স্পেসক্রাফট আমাদের সাথে কতদিন যোগাযোগ রাখবে তা কেউ জানে না তবে কোনো একদিন না একদিন মহাবিশ্বের গভীরতায় বিলীন হয়ে যাবে। 

 
ভয়েজার ওয়ান



ভয়েজার ওয়ান এর প্রথম মিশনটা ছিল বৃহস্পতি এবং শনির রিসার্চ করা এবং সেগুলোর সঠিক ইনফর্মেশন পাঠানো। এইসব ইনফর্মেশন পাঠানো উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত এই স্পেসক্রাফটি নিজের যাত্রা শুরু করেছিল।  তবে ভয়েজার ওয়ানকে শুধুমাত্র কোন রিসার্চ এর জন্য পাঠানো হয়নি বরং সেই স্পেসক্রাফটির সাথে পাঠানো হয়েছিল আমাদের মানবজাতির সম্পর্কে অনেক কিছু তথ্য। সেটার কারণ হচ্ছে যদি এই অসীম মহাবিশ্বে কোন এলিয়েন সভ্যতা ভয়েজার ওয়ানকে কোনদিন খুঁজে পায় তাহলে তারা আমাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারবে। এটি ছিল মানবজাতি দ্বারা পাঠানো একটা বার্তা। এই বার্তাগুলি ভয়েজার ওয়ানে অবস্থিত একটি গ্রাম্য ফোনের ভেতরে রয়েছে। এই গ্রাম্য ফোনে রয়েছে পৃথিবীর কিছু ভিডিও ও সাউন্ড। গ্রাম্য ফোনটিকে তৈরি করা হয়েছে কপার ডিস্ক দিয়ে। অনুমান করা হয় যে এই গ্রাম্য ফোন প্রায় 100 কোটি বছর ঠিকঠাক থাকবে। স্পেসক্রাফটিকে যখন লঞ্চ করা হয় তখন ভয়েজার টু এর চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগামী ছিল আর সে জন্যই ভয়েজার ওয়ান স্পেসক্রাফটি আমাদের সৌরমন্ডলে থাকা গ্রহাণু বেল্টকে ভয়েজার টু এর আগেই পার করেছিল। মহাকাশে লম্বা যাত্রা করার পরেই , এই স্পেসক্রাফটি 1979 সালের মার্চের 5 তারিখে প্রথমবার বৃহস্পতির কাছে যেয়ে পৌঁছায়। এই  স্পেসক্রাফটটি বৃহস্পতি ও বৃহস্পতির আশেপাশের বিভিন্ন উপগ্রহ গুলির হাইরেজুলেশন কিছু ছবি তুলে আমাদেরকে পাঠায়। ভয়েজার ওয়ান এর দ্বারা বৃহস্পতির চুম্বক ক্ষেত্র ও বিভিন্ন বিকিরণ এর ব্যাপারে অনেক কিছু তথ্য জানা যায়। এই স্পেসক্রাফটি নিজের যাত্রাতে বৃহস্পতির একটি উপগ্রহের আয়ুর ব্যাপারে একটি বিশাল ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আমাদের কাছে পাঠায়। ভয়েজার ওয়ান এই উপগ্রহটিতে  আগনিওগিরির থাকার প্রমাণ দিয়েছে যার ফলে মানব সভ্যতা প্রথমবারের মতো চিনেছিল যে কোন গ্রহের মতো তাদের উপগ্রহগুলোরও একটি অ্যাক্টিভ ইন্টেরিয়ার থাকতে পারে। বৃহস্পতির কাছ দিয়ে যখন ভয়েজার ওয়ান যাচ্ছিল তখন এটি 19000 ছবি পাঠায়। এরপর স্পেসক্রাফট বৃহস্পতির মিশনটি শেষ করে সেটার গ্রাভিটি থেকে বের হয়ে শনির দিকে অতিক্রম করে আরও একটা লম্বা যাত্রার পর 12 ই নভেম্বর 1980 সালে শনির কাছে পৌঁছায়। যখন ভয়েজার ওয়ান এবং শনির মাঝের নূন্যতম দূরত্ব ছিল এক লক্ষ 34 হাজার কিলোমিটার তখন শনি গ্রহের এই রিংসগুলোর ব্যাপারে আমাদের অনেক ইনফরমেশন পাঠায় এবং এর সাথে প্রথমবারের মতো একটা নতুন রিংস (G-RING) এর ব্যাপারে আমরা জানতে পারি , এর সাথে শনি গ্রহের কিছু চাঁদের ব্যাপারেও জানা যায়।  শনির মিশনে ভয়েজার-ওয়ান এমন একটা ছবি তুলে পাঠায় যেটাতে টাইটানের উপর কমলা রঙের মেঘ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না আর তারপর থেকেই শনির এই উপগ্রহটির ব্যপারে অনেক ধরনের কন্সপিরেসী থিওরী আমাদের কাছে এসেছিল। এরপর ভয়েজার ওয়ান এর সৌরমন্ডলের বাকি গ্রহগুলির এক্সপ্লোরেশন কাজও শেষ হয়ে গিয়েছিল। শনি গ্রহকে ফ্লাইব্যাক করার পর ভয়েজার ওয়ান শনি গ্রহের গ্রাভিটির জন্য এতোটাই বেগ লাভ করে নিয়েছিল যেন সেটি আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে যেতে পারে। এরপর প্রথমবারের মত যাত্রা শুর করে আমাদের অসীম মহাবিশ্বের দিকে ভয়েজার ওয়ান। যখন আমাদের সৌরমন্ডলের ছেড়ে যাচ্ছিল তখন আমাদের পৃথিবীর দিকে ভয়েজার ওয়ান শেষ বারের মত নিজের ক্যামেরাটি ঘুরায় এবং একটা ছবি তুলে আমাদেরকে পাঠায়। এই ছবিটিকে 1990 সালের 14 ফেব্রুয়ারীতে তুলা হয় তখন ভয়েজার ওয়ান পৃথিবী থেকে 600 কোটি কিলোমিটার দূরে ছিল। এরপর ভয়েজার ওয়ান স্পেসক্রাফট আমাদের সৌরমন্ডলের হেলিওস্ফিয়ারে অতিক্রম করে নিজের ইন্টারস্টেলার ট্রাভেলের জন্য রওনা দেয়। 2006 সালের 16ই আগস্টে 100  অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট পার করেছিল। এটা 121 অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (121AU) দূরত্ব থেকে আমাদের সৌরমন্ডল কে অতিক্রম করেছিল। ভয়েজার ওয়ান মানবজাতির দ্বারা তৈরি প্রথম স্পেসক্রাফট যেইটা 2012 সালের 1ই আগস্ট ইন্টারস্টেলার স্পেস এ ট্রাভেল করেছে। যেখানে ভয়েজার টু ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল করতে আরো ছয় বছর লেগে গিয়েছিল। ভয়েজার টু নভেম্বর 2018 সালে ইন্টারস্টেলার স্পেস এ প্রথমবার প্রবেশ করেছিল। ভয়েজার ওয়ান এবং ভয়েজার টু দ্বারা 67 হাজার ছবি তোলা হয়। 


ভয়েজার ওয়ান থেকে তোলা বৃহস্পতি গ্রহের ছবি




1990 সালের 14 ফেব্রুয়ারীতে ভয়েজার ওয়ান দিয়ে তোলা পৃথিবীর শেষ ছবি




ইন্টারস্টেলার স্পেইস আসলে কি ? 


সূর্য থেকে বের হওয়া সোলার শক্তির জন্য আমাদের  সৌরমন্ডলের চারিদিকে একটা বুদবুদের মত গোলাকার বলয় রয়েছে এই গোলাকার বলয় এর ভিতরটিকে বলা হয় হেলিওস্ফিয়ার এবং এর বাইরের পুরো জায়গাটিকে বলা হয় ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম। 43 বছর ধরে শুরু হওয়া স্পেসক্রাফটি আজকেও একটিভ রয়েছে। মহাবিশ্বের সব রহস্যময় বস্তুগুলোর ব্যাপারে এই স্পেসক্রাফটি জানিয়েছে আমাদের অনেক তথ্য। ভয়েজার ওয়ান এর শক্তি অনেকটা কমে গেছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এরকম খুব কমই মিশন করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা এত কিছু জানতে পেরেছি। ভয়েজার ছিল মানব তৈরি এমন একটি স্পেসক্রাফট যার কন্ট্রোল ছিল কম্পিউটারের হাতে। কিন্তু ভয়েজার ওয়ান আর ভয়েজার টু এই দুইটি স্পেসক্রাফট আজ থেকে 43 বছর ধরে নিজে নিজেই তাদের যাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেই নিজের সব ইন্সটুমেন্টস এর দেখাশোনা করে আর দরকার হলে ভয়েজার-ওয়ান নিজের ব্যাকআপ সিস্টেমও চালু করে। আজ 43 বছর পর আমাদের টেকনোলজি অনেক উন্নত হয়ে গেছে। তাছাড়া ভয়েজারও অনেক পুরানো হয়ে গেছে। এখন ভয়েজার ওয়ান থেকে পাঠানো সিগনালগুলো রিসিভ করার জন্য নাসা সারা দুনিয়াতে রিসিভার লাগিয়েছে। এই কথাটি ঠিক এরকমই যদি আপনি শহর ছেড়ে কোন দূরদূরান্ত জায়গায় যান তাহলে সেখানে আপনার মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেতে যেমন সমস্যা হয় ঠিক তেমনই ভয়েজার ওয়ান থেকে আসা সিগন্যালগুলো পেতে যাতে নাসার কোন সমস্যা যাতে না হয় সে জন্য সারা দুনিয়াতে বড় বড় স্যাটেলাইট ডিস্ক লাগিয়ে ভয়েজার ওয়ান থেকে আসা সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে। পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা যখন ভয়েজার ওয়ান এর সাথে সম্পর্ক করতে চায় তখন পৃথিবীতে লাগানো বিভিন্ন রাডার এর মাধ্যমে 20 কিলোওয়াটের একটা সিগন্যাল পাঠাতে হয়। এই সিগন্যাল প্রায় 20 ঘণ্টা পর ভয়েজার ওয়ানের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। যেখানে ভয়েজার ওয়ানের সেনসিটিভ এন্টিনাগুলি সেটাকে রিসিভ করে এবং 20 ওয়াটের আরও একটা সিগন্যাল আমাদের কাছে পাঠায় মানে ফিরতি একটা ম্যাসেজ পাঠায় যা আমাদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দুর্বল হয়ে যায় আর যখন এটা আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছায় তখন এটাকে ডিটেক্ট করা হয়ে যায় আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ তখন সিগন্যালের ফ্রিকোয়েন্সি হয়ে যায় খুবই দুর্বল। নাসা এজেন্সি এই সিগন্যালগুলোকে ব্যবহার করার জন্য বর্তমানে ডীপ স্পেস নেটওয়ার্কের ব্যবহার করছে আর যার ফলে বিজ্ঞানীরা ভয়েজার ওয়ান এর সাথে একটা টেম্পোরারি সম্পর্ক বানিয়ে রেখেছে। আজ অব্দি এটার মধ্যে ব্যবহৃত যেসব যন্ত্র পুরনো হয়ে গেছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে সাথে ভয়েজার ওয়ান এবং ভয়েজার টু এর ক্যামেরা গুলো বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ ভয়েজার ওয়ানে যে পরিমান শক্তি রয়েছে সেগুলো কে বাঁচিয়ে মেইন কম্পোনেন্টগুলোকে গরম রাখা হচ্ছে। বর্তমানে ভয়েজার ওয়ান শুধুমাত্র চারটি যন্ত্রই একটিভ রয়েছে যেগুলো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং সোলার ওয়িন্ড সম্পর্কিত ডাটা কালেক্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এই উপকরণগুলো দিয়ে আমাদের পৃথিবী এবং ভয়েজার ওয়ান এর সাথে কমিউনিকেট করা হয়। এই স্পেসক্রাফটি আমাদের থেকে 152.2 অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্ব রয়েছে।যেখানে  1AU = 150 মিলিয়ন কিলোমিটার । পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হচ্ছে এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট। আমরা আর কতদিন পর্যন্ত এই ভয়েজার ওয়ান এর সাথে কন্টাক্ট রাখতে পারব তা কেওই জানে না।


No comments

Mansa Musa

✱ বর্তমান আধুনিক বিশ্বে কোনো ধনোকুপ এর কথা উঠলে সবাই বিল গেটস, জেফ বেজোজ অথবা ইলন মাস্ক এর কথা বলবেন যাদের অর্থের সঠিক কোনো হিসাব নেই। কিন্ত...

Powered by Blogger.