আপনারা যারা শহরে বা গ্রামে থাকেন সবাই হয়তো আকাশে তারা দেখতে পান। কিন্তু আপনি কি জানেন আমাদের মহাবিশ্বে কি কি আছে , এর সীমা কত দূর , মহাবিশ্ব কত বড় ?
মহাবিশ্বের শেষ সীমানা জানার আগে আমাদের সৌরজগতের সম্পর্কে কিছু ধারণা নিয়ে নেই -
পৃথিবীর ভূমি থেকে 8-14.5 কিলোমিটার উচ্চতার জায়গাটিকে ট্রপোস্ফিয়ার বলা হয়। এই উচ্চতায় আমাদের বায়ুমণ্ডলের 80% ভর হয়ে থাকে এবং এর উপর দিয়েই বেশিরভাগ উড়োজাহাজ উড়ে থাকে। ট্রপোস্ফিয়ার থেকে 50 কিলোমিটার উচ্চতা জুড়ে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অবস্থিত। এই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ওজোন স্তর থাকে যা সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার থেকে 85 কিলোমিটার উচ্চতা জুড়ে মেসোস্ফিয়ার অবস্থিত।মেসোস্ফিয়ার থেকে 600 কিলোমিটার উচ্চতা জুড়ে থার্মোস্ফিয়ার অবস্থিত। এরপর পৃথিবীর সর্বশেষ বায়ুস্তর যা থার্মোস্ফিয়ার থেকে 10000 কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত এক্সোস্ফিয়ার অবস্থিত। এই এক্সোস্ফিয়ার এর সাথে আমাদের বায়ুমণ্ডলের সীমানাও শেষ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সহ বেশিরভাগ স্যাটেলাইটই এই এক্সোস্ফিয়ারে রয়েছে।
 |
| Earth Atmosphere (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল) |
এখন আরেকটু দূরে যাওয়া যাক , পৃথিবী থেকে 384400 কিলোমিটার দূরে চাঁদ অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন আজ থেকে প্রায় 4.5 বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল গ্রহের মত একটা গ্রহ পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ফলে চাঁদের উৎপত্তি হয়েছে। পৃথিবী থেকে 15 কোটি কিলোমিটার দূরে সূর্যের অবস্থান। এই সূর্যই আমাদের সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র যার ফলে পৃথিবীর সমস্ত জীব বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছে। সূর্যের প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবেই আমাদের সৌরমণ্ডলের সমস্ত গ্রহ এবং উপগ্রহ তাদের সঠিক জায়গায় এবং সঠিক অক্ষপথকে অনুকরণ করে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সূর্যের সবথেকে কাছের গ্রহটি হলো বুধ (Mercury)। যা সূর্য থেকে 57.91 মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বুধের পৃষ্ঠের চারদিকে বড় বড় ক্রেটার এ ভর্তি। এখনো পর্যন্ত Mariner 10 এবং MESSENGER এই দুইটি মহাকাশযান বুধ এ যেতে পেরেছে। MESSENGER 2008 সালের জানুয়ারিতে বুধ এর হাই কোয়ালিটি ছবি আমাদেরকে পাঠায়। এই দুইটি মহাকাশযান দ্বারা বুধ এর প্রায় 50% এলাকার ম্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু সূর্যের অনেক তাপ এবং রেডিয়েশন এর ফলে বাকি জায়গায় ম্যাপ এখনো পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এরপর আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহটি হলো শুক্র (Venus)। এই গ্রহটি সূর্য থেকে 102.8 মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গ্রহটির আকার , আয়তন এবং অভিকর্ষজ বল অনেকটা পৃথিবীর মতোই। এই গ্রহটির পৃষ্ঠদেশ আমরা টেলিস্কোপ এর মাধ্যমে দেখতে পাইনা। কারণ এই গ্রহটি চারিদিক থেকে এসিডের তৈরি মেঘে ঘেরা। শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ লক্ষ ছোট বড় আগ্নেয়গিরিতে ভর্তি। এই গ্রহে 100 বর্গ কিলোমিটার এর মধ্যে প্রায় 150 টা বড় বড় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এর বায়ুমণ্ডলের প্রচুর পরিমাণে মেঘ থাকা সত্বেও এই গ্রহে কোনো বৃষ্টি হয় না। যদিও পৃষ্ঠদেশ থেকে কয়েক কিলোমিটার ওপরে এসিড বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু সেই এসিড বৃষ্টি শুক্রের পৃষ্ঠদেশে আসার 25 কিলোমিটার ওপরেই বাষ্পে পরিণত হয়ে যায়। গবেষকরা ধারণা করেন যে কয়েক বিলিয়ন বছর পূর্বে এই গ্রহে পানি ছিল। যা সময়ের সাথে সাথে বাষ্পে পরিণত হয়েগেছে। তবে গবেষকরা মনেকরেন শুক্রের উপরের মেঘস্তর এবং নিচের মেঘস্তর এর মধ্যে বসবাস করার মত জায়গা আছে। সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহটি হলো মঙ্গল (Mars)। যা সূর্য থেকে 227.9 মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। 1965 সালের 14 ই জুলাই Mariner 4 এই গ্রহের 21 টি ছবি পাঠায়। এখনো পর্যন্ত পাঠানো সব মঙ্গলযান এর রিসার্চ থেকে আমরা জানতে পারি , যে আমাদের সৌরজগতের সমস্ত গ্রহের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া শুধুমাত্র মঙ্গলই আছে যেখানে জীবন ও পানি পাওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই গ্রহটিকে এমনভাবে দেখে যে মানুষ কোনো একদিন হয়তো এই মঙ্গল গ্রহে বসবাস করতে পারবে। মঙ্গল এর পর আমরা দেখতে পাবো গ্রহাণু বেল্ট। এই গ্রহাণু বেল্ট মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাজখানে থেকে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এরপর আমাদের সৌরজগতের পঞ্চম এবং সবথেকে বড় গ্রহ বৃহস্পতি (Jupiter)। যা সূর্য থেকে 778.5 মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গ্রহটির 75 টির বেশি উপগ্রহ আছে। এই গ্রহটি এতটাই বড় যে এর মধ্যে 1300 এর বেশি পৃথিবী রাখা যাবে। এই গ্রহের গ্রেট রেড স্পটটি এক ভয়ংকর ঝড় থেকে হয়েছে। শুধুমাত্র এই রেড স্পটটি পৃথিবীর থেকে দুইগুন বড়। অনুমান করা হয় এই রেড স্পটটির ঝড় প্রায় 151 বছর ধরে চলছে। আমাদের সৌরজগতের ষষ্ঠ স্থানে আছে শনি (Saturn) গ্রহ। এই গ্রহটি সূর্য থেকে 1.434 বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই গ্রহটির প্রায় 82 টি উপগ্রহ আছে। এই উপগ্রহগুলোর মধ্যে একমাত্র টাইটান উপগ্রহ আছে যার বায়ুমণ্ডল আছে। শনির গোলাকার বলয় ছোট ছোট গ্রহাণু এবং বরফের কণা দিয়ে তৈরি। এরপর আমাদের সপ্তম গ্রহটি হলো ইউরেনাস (Uranus)। যা সূর্য থেকে 2.871 বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এরপর নেপচুন গ্রহটি আমাদের সৌরজগতের শেষ গ্রহ যা সূর্য থেকে 4.495 বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
 |
| Solar system (সৌরজগত) |
নেপচুন এর পরে আমরা কুইপার বেল্ট দেখতে পাবো যা পূর্বের গ্রহাণু বেল্ট এর থেকে 20 গুন বড়। যা সূর্য থেকে 50 AU (Astronomical unit) দূরে অবস্থিত। এই কুইপার বেল্ট বিভিন্ন ধরনের বরফ , অ্যামোনিয়া এবং মিথেন দ্বারা তৈরি। আর আমাদের প্লুটোও এই কুইপার বেল্ট এর সদস্য। এই কুইপার বেল্ট ছেড়ে যখন আরো দূরে যাবো তখন আমরা মানব তৈরি মহাকাশযান ভয়েজার ওয়ান দেখতে পাবো। যা পৃথিবী থেকে 52.2 AU দূরে আছে। আমাদের সৌরজগত থেকে আরোও অনেক দূরে মানে সূর্য থেকে প্রায় 2000 - 100000 AU দূরে Oort cloud অবস্থিত। এতো দূরেও সূর্যের অভিকর্ষ বল শেষ হয়ে যায়নি। এই Oort cloud এ বিলিয়ন বিলিয়ন Comets (ধূমকেতু) রয়েছে যা মেঘের মতো সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গবেষকরা ধারণা করেন সূর্যের মহাকর্ষ বলের শেষ সীমানায় এই Oort cloud অবস্থিত আছে। এরপর সূর্যের টানের প্রভাব শেষ হয়ে যায়। এইখানেই আমাদের সৌরজগত এর সীমানা শেষ।
 |
| Oort cloud |
আমাদের সৌরজগতকে ছেড়ে যখন আরও দূরে যেতে থাকবো তখন আমরা Intersteller এ পৌঁছে যাবো। আর এখানে AU থেকে আমাদেরকে স্বিফট করতে হবে লাইট ইয়ারস এ। কারণ এখানে আমরা AU টে কুলাতে পারবো না। কোনো জিনিস আলোর গতিতে এক বছর এ যতদূর যেতে পারবে ওই পুরো বছরটাই 1 লাইট ইয়ারস বলা হয়ে থাকে। আর আলো 1 সেকেন্ড এ 3 লক্ষ কিলোমিটার গতিতে ভ্রমণ করে থাকে। Intersteller এ যেতে যেতে অনেক অন্ধকার জায়গাগুলোতে দুর্বৃত্ত (Rogue) গ্রহ ধেকেতে পাবো। তবে এই অন্ধকার গ্রহগুলোকে দেখতে হলে ইনফ্রারেড ভিশন এর প্রয়োজন হবে। এই দুর্বৃত্ত গ্রহগুলোর কোনো নক্ষত্র নেই। আমাদের ছায়াপথে (Galaxy) এমন কোটি কোটি গ্রহ রয়েছে যাদের কোনো নক্ষত্র নেই। বিজ্ঞানীরা মনেকরেন এই গ্রহগুলোর উপরে বরফের আবরণ দ্বারা ডাকা থাকতে পারে কিন্তু ভিতরের কেন্দ্রে পানির সমুদ্র থাকতে পারে।
 |
| Rogue planet (দুর্বৃত্ত গ্রহ) |
আমাদের সূর্যের থেকে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র হলো প্রক্সিমা সেন্টোরি (Proxima Centauri)। এই নক্ষত্রটি সূর্য থেকে 4.2465 লাইট ইয়ারস দূরে অবস্থিত। ভবিষ্যতে আলোর গতির কোনো স্পেসক্রাফট বানাতে পারলেও এই নক্ষত্রতে পৌঁছাতে প্রায় 4.5 বছর লেগে যাবে। আরো দূরে যেতে যেতে আমরা মিল্কি ওয়ে (Milky Way) গ্যালাক্সি দেখতে পাবো। এই গ্যালাক্সির মধ্যে 100 - 400 বিলিয়ন তারা বা নক্ষত্র রয়েছে। এই নক্ষত্র গুলোর মধ্যে এমন নক্ষত্রও আছে যাদের সূর্যের মত সৌরজগত আছে। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে 27000 লাইট ইয়ারস দূরে আমাদের সৌরজগত অবস্থিত। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি 1 লক্ষ লাইট ইয়ারস এর বেশি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। যদি কেউ আলোর গতিতে এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি ঘুরতে চায় তাহলে তার 1 লক্ষ বছর লাগবে। আর কিছু দূরে গেলেই আমরা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি (Andromeda Galaxy) দেখতে পাবো। গবেষকরা অনুমান করেন যে আমাদের গ্যালাক্সি এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি খুব দ্রুত গতিতে একে অপরের দিকে ছুটে আসছে আর প্রায় 4 বিলিয়ন বছর পর এরা একে অপরের সাথে ধাক্কা খাবে।
 |
| Milky way galaxy (মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি) |
 |
| Andromeda Galaxy (অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি) |
এরপর আমরা লোকাল গ্রুপ গ্যালাক্সির (Local Group Galaxy) কাছে। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি সহ 50 টির বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে। এই লোকাল গ্রুপ গ্যালাক্সির ব্যাস প্রায় 10 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এর আয়তন বা আকার 5 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস । আরো দূরে আমরা Virgo supercluster দেখতে পাবো। এই Virgo supercluster এর ব্যাস 110 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এর আকার 55 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস। এর ভেতর মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি সহ 100 টির বেশি লোকাল গ্যালাক্সি রয়েছে। এরপর আরো দূরে আমরা Laniakea Supercluster দেখতে পাবো। এই Laniakea Supercluster এর ব্যাস 500 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং আকার 250 মিলিয়ন লাইট ইয়ারস । আমাদের গ্যালাক্সি সহ আরো 1 লক্ষ গ্যালাক্সি এই Laniakea Supercluster এ অবস্থিত। এই Laniakea Supercluster ও অনেক অনেক ছোট আমাদের Observable universe এর কাছে। আমাদের এই পুরো Observable universe এর মধ্যে প্রায় 2 ট্রিলিয়ন এর বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে। এখানে এতই গ্যালাক্সি রয়েছে যে আমাদের পৃথিবীর বালুকণা একটা একটা করে গণনা করলেও কম হয়ে যাবে। এই Observable universe এর ব্যাস 93.016 বিলিয়ন লাইট ইয়ারস এবং আকার 46.508 বিলিয়ন লাইট ইয়ারস। আর এই Observable universe প্রতিনিয়তই আলোর চেয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে মানে এর দূরত্ব প্রতিনিয়তই বাড়তেই চলেছে।
 |
| Local Group Galaxy |
 |
| Virgo supercluster |
 |
| Laniakea Supercluster |
 |
| Observable universe |
এই Observable universe ও ছোট্ট একটা অংশ আমাদের মহাবিশ্বের। Cosmic inflation theory of DR. Alan guth এর থেকে জানা যায় আমাদের যেই Observable universe টি আছে সেইটা শুধু ছোট্ট একটা বিন্দু আমাদের মহাবিশ্বের কাছে। DR. Alan guth এর মতে আমাদের মহাবিশ্ব 150 সেক্সট্রিলিয়ন (Sextillion) বড় Observable universe থেকে। আর 1 সেক্সট্রিলিয়নে 21 টি শূন্য থাকে। এইটাই তার থিওরী। এইটা শুধু ধারণা আর ধারণা ভুল ও হতে পারে। তবে আমরা পৃথিবী থেকে আকাশে যা যা দেখছি এগুলো একটাও আমাদের বর্তমান নয় সবগুলোই আমাদের অতীত।কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে 8 মিনিট 20 সেকেন্ড সময় নেয়। সেজন্যই এখন আমরা যেই সূর্যটাকে দেখি সেইটা 8 মিনিট আগে ছিল। একইসাথে আকাশে আমরা যেই লক্ষ লক্ষ তারা দেখতে পাই যেগুলো লক্ষ লক্ষ লাইট ইয়ারস দূরে সেগুলো আমরা অনেক আগে থেকেই দেখতে পারছি। কেউ জানেনা বর্তমানে ওই তারা গুলোকে কেমন দেখাবে। বর্তমানে আমাদের গবেষকদের কাছে মহাবিশ্বের শেষ সীমানা কোথায় তার কোনো প্রমাণ নেই।
I benefited from knowing this article
ReplyDelete